বর্তমানে জনপ্রিয় ফুল গাছের অন্যতম নীলমণিলতা I গাছটি বহুবর্ষজীবী এবং লতানো প্রকৃতির হয়, বহুবর্ষজীবী লতাজাতীয় ফুলগাছ টি উচ্চতায় প্রায় ৫ থেকে ৬ মিটার (১৫- ২০ ফুঁট) পর্যন্ত হতে পারে। ফুলের পাপড়ি গুলি দুই স্তরে সাজানো থাকে, নিচের স্তর হালকা বেগুনি রঙের এবং উপরের স্তর গাঢ় বেগুনি রঙের চওড়া পাঁপড়ি হয়ে থাক। নীলরঙা প্রতিটি ফুলে পাঁচটি করে পাপড়ি থাকে। প্রতিটি পুষ্পমঞ্জরিতে ১০ থেকে ৩০ বা তারও বেশি ফুল থাকে। গাছের প্রতিটি ডালের শীর্ষে গুচ্ছ আকারে প্রচুর ফুল ফোটে। শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরু থেকে গাছে ফুল ফোটা শুরু হয় এবং শীত আসতেই গাছে ফুল কমে যেতে দেখা যায় অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাস গাছের flowering season। গাছের প্রতিটি ফুল ৪-৫ দিন স্থায়া হয় এবং ফুল গুলি গাছ থেকে ঝড়ে পড়ে গেলেও হালকা নীল রং এর বৃন্তগুলো অনেক দিন থাকে। সারা বিশ্বে ১৩০ প্রজাতিরও বেশি নীলমণি লতা রয়েছে।
শান্তিনিকেতনের উত্তরায়নের কোণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাড়ির আঙিনায় একটি বিদেশি চারা রোপণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু পিয়ার্সন। পরবর্তী সময়ে শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন তার নজরে আসে বিশেষ গাছটি ও সেই সময় গাছটি ফুলে ফুলে পরিপুর্ণ ছিল, তার নীলাভ শোভা আর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার নাম দেন নীলমণি লতা। তারপর তিনি ফুলটিকে নিয়ে লেখেন একটি গান।
"ফাল্গুনমাধুরী তার চরণের মঞ্জীরে মঞ্জীরে
নীলমণিমঞ্জরির গুঞ্জন বাজায়ে দিল কি রে।
আকাশ যে মৌনভার
বহিতে পারে না আর,
নীলিমাবন্যায় শূন্যে উচ্ছলে অনন্ত ব্যাকুলতা,
তারি ধারা পুষ্পপাত্রে ভরি নীল নীলমণি লতা"
সেই সময় থেকে গাছটি বাংলা তথা সারা বিশ্বের কাছে নীলমণিলতা নামে পরিচিতিI এই গাছের সঙ্গে কবিগুরুর একটা সম্পর্ক রয়েছে এবং এই গাছটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত প্রিয় গাছ হিসেবে পরিচিত বলেই সে তার নিজের বাগানে গাছটিকে অ্যাসেট হিসেবে সংগ্রহ করে রেখে ছিলেন I
চারা কোথায় পাবেন ?
নীলমণিলতা গাছের চারা সংগ্রহের সময় রোগ মুক্ত, ভালো ও সুস্থ সবল চারা নির্বাচনের জন্য। যেকোনো নার্সারি থেকে আপনি চারা সংগ্রহ করতে পারেন, ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যেই আপনি চারা পেয়ে যাবেন বা তার চেয়েও কমবেশি হতে পারে।
স্থান নির্বাচন:-
গাছটি মোটামুটি দিনে ৪ থেকে ৬ ঘটা রৌদ পাই তেমন প্রতিস্থাপন করা উচিত, এতে গাছের বাড়বাড়ন্ত ভালো হয় এবং রোগে আক্রান্ত কম হয়। গাছটি কে মাটিতে বসানোর ৭-৮ মাস পরেই ফুল আসা শুরু হয়। 'নীলমণি লতা' বর্ধনশীল কাষ্টল উদ্ভিদ। সুনিষ্কাশিত যে কোনো ধরনের মাটিতেই এই উদ্ভিদ জন্মায়।
অন্যান্য গাছের মতোই এই গাছটি যদি সরাসরি মাটিতে বসানো যায় তবে তার জন্য নূন্যতম পরিচর্যার প্রয়োজন I গাছটিকে মাটিতে বসানোর পূর্বে জায়গাটি কে ভালো করে জৈবসার দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হবেI পরবর্তী সময়ে গাছটি নিজেই তার চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিমৌল মাটি থেকে শোষণ করে বেড়ে উঠবে । তবে বছরে একবার হলেও গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন, তবে গাছটি যদি টবে প্রতিস্থাপন করতে চান, তাহলে গাছটির চাহিদা অনুযায়ী খাবার,আলো,জল, কীটনাশাক সঠিক মত করতে হবেI আর সেই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা নিম্নে বর্ণিত হলো।
টব নির্বাচন ও মাটি প্রস্তুত:-
নীলমণিলতা একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ তাই ভালো হয় বড় গামলা জাতীয় টব নির্বাচন করলেI টবে প্রতিস্থাপন করলে ১০ ইঞ্চি অথবা ১২ ইঞ্চি টব নির্বাচন করতে হবে। গাছটি টবের তুলনায় মাটিতে খুব ভালো হয় প্রথমেই বলেছিলাম তাই গাছটি টবে বড় হওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্যের প্রয়োজন হয়।নীলমনিলতা একটু ভারী ধরণের মাটি অর্থাৎ এটেঁল মাটি পছন্দ করে। এই গাছটি প্রতিস্থাপনের পূর্বে দু ভাগ মাটি নিতে হবে আর নিতে হবে একভাগ জৈব সার (এক বছরের পুরনো গোবর সার/ পাতা পঁচা/ভার্মিকম্পোস্ট), আর নিতে হবে হাঁড় গুড়ো, শিং কুঁচি এবং পরিমাণ মতো নিম খোল দ্বারা মাটি প্রস্তুত করে গাছটি টবে প্রতিস্থাপন করতে হবে । টবে প্রতিস্থাপন করলে মাটির ময়েশ্চার ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করতে হবে কোকোপিট অথবা কাঠের গুঁড়ো ।
প্রতিস্থাপন পদ্ধতি :-
প্রথমে টবের ছিদ্র গুলোকে ইটের টুকরো/ টব ভাঙা টুকরো দিয়ে আটকে দিতে হবে, ছিদ্র গুলোকে আটকে দেওয়ার পর কিছু বালি-নুড়ি টবের মধ্যে বিছিয়ে দিয়ে এক ইঞ্চি বেড তৈরি করতে হবে যাতে অতিরিক্ত জল ড্রেনেজ সিস্টেম থেকে টবের বাইরে বেরিয়ে যায়। এর পর অল্প পরিমাণ মাটি দিয়ে গাছটি টবের ঠিক মাঝ বরাবর বসাতে হবে। এরপর প্রয়োজনানুযায়ী মাটি ভালোকরে ঠেসে ঠেসে দিতে হবে কারণ ঠেসে দিলে মাটির মধ্যে থাকা বাতাস বেরিয়ে যায় ফলে গাছের শিকড় পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রতিস্থাপন হয়ে গেলে প্রায়াজন মতো জল দিয়ে দিতে হবে।
বি:দ্র:—টবে মাটি দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে টবের ওপর 2 ইঞ্চি ফাঁকা জায়গা থাকে।
আলো :-
নীলমণিলতা গাছ যেহেতু রৌদ খুব ভালোবাসে তাই যেখানে দিনে ৪ থেকে ৬ ঘটা সরাসরি রৌদ পাই সেখানে টবটি রাখতে হবে। ব্যালকনিতে ও করা যায় তবে সেক্ষেত্রে গাছটির উপরি অংশ ব্যালকনির বাইরে বের করে দিতে হবে। এতে যতটুকু রোদ পাবে তাতেই গাছটি সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠতে পারবে।
জল :–
এই গাছে জলের চাহিদা সেভাবে নেই। তাই জল কম অথবা বেশি হলেও গাছের কোন অসুবিধা হয় না। যখন মাটির ময়েশ্চার একটু কম থাকবে তখন জল দেওয়ার প্রয়োজন হবে । শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেন কখনই জল না জমে। শীতকালে গাছে খুব বেশি জলের প্রায়াজন হয় না, তবে গরমকালে টবের গাছে প্রয়োজন বুঝে জল দেওয়া খুবই প্রায়াজন। বর্ষাকালে গাছটিকে একটু সাবধানে রাখবেন ।
0 Comments